নিউজ ডেস্ক: ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে জেলা পরিষদ নির্বাচনে টানা দুবার লজ্জাজনকভাবে হেরেছেন শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার পাল। এছাড়া রাজাকার ও বিএনপি-জামায়াত নেতাদের টাকার বিনিময়ে কমিটিতে পদ-পদবি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
পাশাপাশি দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি গুদামে বিভিন্ন রকম ব্যবসা, সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চাঁদাবাজিসহ নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগ উঠেছে চন্দন কুমারের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ হচ্ছে, মহিলা আওয়ামী লীগ এবং যুব মহিলা লীগের নেত্রীদের যৌন হয়রানি ও তাদের সম্পর্কে অশালীন ভাষায় মন্তব্য করেন চন্দন কুমার পাল।
এসব বিষয়ে গত ১২ নভেম্বর দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল খালেক। অভিযোগে দাবি করা হয়, শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার পাল জেলার ৫২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত নেতাসহ বিতর্কিতদের মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে জনপ্রতি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা করে নিয়েছেন।
তাদের বেশির ভাগই নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। আবার যারা পাননি তাদের টাকাও ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। এছাড়া রাজাকার, বিএনপি-জামায়াত নেতাদের টাকার বিনিময়ে কমিটিতে পদ-পদবিতে রাখা, দলবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি গুদামে বিভিন্ন রকম ব্যবসা, সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চাঁদাবাজিসহ নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত চন্দন কুমার পাল। এমনকি কখনো উপজেলায় দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণও করেন না তিনি। এতে করে ক্ষমতায় থেকেও দলকে ইমেজ সংকটে ফেলে দিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, শেরপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার পাল। এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি করেন না এবং তার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। গত নির্বাচনে দুজন বিএনপির পদ-পদবিধারী নেতাকে নৌকার টিকিট দিয়েছেন ঘুসের বিনিময়ে। অন্যদিকে ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের দল থেকে বিতাড়িত করেছেন।
এক কথায় চন্দন কুমার একাই শেরপুর আওয়ামী লীগের রাজনীতির কোমর ভেঙে দিয়েছেন বলে দাবি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। চন্দন কুমারের নানা অনিয়মের কারণে বর্তমানে আওয়ামী লীগ শেরপুরে ইমেজ সংকটে রয়েছে। এ নিয়ে তার ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে পারছেন না।
নলকোড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, চন্দন কুমার পাল পদে বসে থেকে শেরপুর আওয়ামী লীগের কোমর ভেঙে দিয়েছেন। গত নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের বাদ দিয়ে ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতীবান্ধা ইউনিয়নের বিএনপি নেতা ওবাইদুল, ধানশাইল ইউনিয়নের ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক তৌফিকুর রহমান এনামুলকে নৌকার প্রতীক দিয়ে নির্বাচন করিয়েছেন।
অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পরও তাদের আর বাদ দেওয়া হয়নি। অথচ তাদের চেনেন না এবং তারা কখনো দলীয় প্রোগ্রামে অংশ নেননি বলে ডিও দিয়েছেন শেরপুর-৩ আসনের সংসদ-সদস্য ইঞ্জিনিয়ার একেএম ফজলুল হক। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি। এরা বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী নয়। নৌকার প্রতীক ও মুজিব কোট পরে আওয়ামী লীগ সাজলেও হৃদয়ে-বুকে ধারণ করেন জিয়াউর রহমানের আদর্শ।
শেরপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুন নাহার বলেন, চন্দন কুমার পালের জন্য নারীদের রাজনীতি করা দায় হয়ে উঠেছে। তিনি সন্ধ্যা হলে মদ খেয়ে পড়ে থাকেন, যুব মহিলা লীগ ও আওয়ামী লীগের নারী নেত্রীদের যৌন হয়রানি করেন ও অশালীন ভাষায় কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আমি তার এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় নেতাদের বলেছি, আন্দোলনও করেছি, তারপরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন শুধু ভরসা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
শামসুন নাহার দাবি করে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে সদ্য শেষ হওয়া জেলা পরিষদ নির্বাচন এবং এর আগে নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েও জামানত হারিয়েছেন। চন্দন কুমার পাল চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত উল্লেখ করে তার হাতে শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন যুব মহিলা আওয়ামী লীগের এই সভাপতি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, কমিশন ও চাঁদা না পেলে সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজেও বাধা প্রদান করেন চন্দন কুমার পাল। চলতি বছরের শুরুতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছ থেকে পুরাতন লোহার ব্যবহার অযোগ্য ভাঙাচোরা মালামাল টেন্ডারের মাধ্যমে নিলামে নিয়েছেন কুষ্টিয়ার টিপু নামে এক ব্যবসায়ী।
এ পুরাতন মাল নিতে চাঁদা দাবি করেন চন্দন কুমার পাল। চাঁদা না দেওয়ার কারণে তিন মাস এসব পুরাতন মালামাল আটকে রাখেন তিনি। পরে মোটা অঙ্কের টাকা এবং একজন সাবেক মন্ত্রীর ফোন পেয়ে মালামাল ছেড়ে দেন চন্দন কুমার পাল।
শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল খালেক যুগান্তরকে বলেন, চন্দন কুমার সাহেব টানা ২০ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। এর সুবিধা নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছ থেকে তিন দফায় মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন। এ কারণে জেলা পরিষদ নির্বাচনে টানা দুবার লজ্জাজনকভাবে হেরেছেন।
শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার পাল। গত জেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলে দলীয় ও বিএনপি-জামায়াতপন্থি প্রার্থীদের কাছ থেকে মনোনয়ন বাণিজ্য করে হাতিয়ে নেন বিপুল পরিমাণ টাকা। এছাড়া বিএনপি-জামায়াতের নেতা ও অযোগ্যদের টাকার বিনিময়ে দলে টেনে শেরপুর আওয়ামী লীগের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছেন চন্দন কুমার পাল।
জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার পাল যুগান্তরকে বলেন, যেসব অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তা কিছু দুষ্ট লোকের পরিকল্পিত অপবাদ। তারা আগামী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আমার পিছু লেগেছে। তা ছাড়া আমি ৩০ বছর ধরে ডায়াবেটিস রোগী, আমি কোনো নারীকে যৌন হয়রানি করিনি বা কুপ্রস্তাবও দেইনি। আমি মদও পান করি না।
তিনি আরও বলেন, মনোনয়ন বাণিজ্য কথাটি ঠিক নয়। কারণ ইউনিয়ন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকের স্বাক্ষরের ভিত্তিতে মনোনয়নের জন্য কেন্দ্রে পাঠানো হয়। আমি জেলা পরিষদ নির্বাচনে কালো টাকার কাছে হেরেছি। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগে স্থান দেওয়ার অভিযোগও সত্য নয়।
সূত্র: যুগান্তর