নাকের কোষই প্রথম টার্গেট করোনাভাইরাসের

172

নিউজ ডেস্ক: মানুষের শরীরের কোন কোন কোষ করোনাভাইরাসের বেশি পছন্দের তার একটা হদিশ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ২০ রকম কোষের বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীদের ধারণা হয়েছে, নাকের কোষকেই প্রথম টার্গেট বানায় সার্স-কভ-২।

শ্বাসনালীর দু’রকমের কোষ বিশেষ পছন্দ এই আরএনএ ভাইরাসের। কারণ এই দুই কোষেই এমন দুটি প্রোটিন খুঁজে পেয়েছে তারা, যাদেরকে মাধ্যম করেই মানুষের শরীরে জাঁকিয়ে বসতে পারে সার্স-কভ-২ ভাইরাল স্ট্রেন।

মানুষের শরীরের কোন কোন কোষকে সবচেয়ে আগে সংক্রামিত করে ভাইরাস সে নিয়ে গবেষণা চলছিল ব্রিটেনের ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউট ও ইউনিভার্সিটি অব মেডিক্যাল সেন্টার গ্রনিনজেনে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, গবলেট কোষ ও সিলিয়েটেড কোষকেই প্রথম নিশানা বানায় এই ভাইরাস। গবলেট কোষ মূলত থাকে শ্বাসপথে, অন্ত্রে অর্থাৎ ক্ষুদ্রান্ত ও বৃহদন্ত্রে। মিউকাস তৈরি করে এই কোষ। সিলিয়েটড কোষ থাকে বিভিন্ন অঙ্গে। ছোট ছোট চুলের মতো অংশ থাকে এই কোষে যাকে বলে সিলিয়া। এর কাজ শরীরে ঢুকে পড়া ক্ষতিকর জীবাণুগুলিকে ছেঁকে বার করে দেওয়া।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, নাক ও গলায় থাকা এই গবলেট ও সিলিয়েটেড কোষকেই নিজেদের হাতিয়ার বলে বেছে নিয়েছে সার্স-কভ-২। ‘নেচার মেডিসিন’ জার্নালে এই গবেষণার রিপোর্ট সম্প্রতি সামনে এনেছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা।

কীভাবে দেহকোষে ঢুকছে এই ভাইরাস?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের হাঁচি-কাশি, থুতু বা লালাকে আধার বানিয়ে ভাইরাস এক শরীর থেকে অন্য শরীরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে নিয়েছে। একেই বলা হচ্ছে রেসপিরেটারি ড্রপলেট। এখন এই রেসপিরেটারি ড্রপলেট শরীরের সংস্পর্শে এলে, তার মধ্যে থাকা ভাইরাস ঝপ করে শরীরে ঢুকে পড়তে পারে না। সংক্রমণ ছড়াতে হলে তাদের মানুষের দেহকোষে ঢোকার রাস্তা খুঁজে বার করতে হয়। কারণ প্রত্যেক কোষেরই একটা রক্ষী থাকে। বাইরে থেকে কেউ সেখানে ঢুকতে এলে তাকে বাধা দেয় কোষের সেই রক্ষী।

সার্স-কভ-২ ভাইরাস এমন কিছু কোষকে খুঁজে বার করেছে যাদের রক্ষীদের সঙ্গে সে বন্ধুত্ব পাতাতে পারে। এই রক্ষীরা হচ্ছে দুই প্রোটিন-ACE2 ও TMPRSS2। এই দুই প্রোটিন শরীরের নানা অঙ্গের কোষেই থাকে। নাক ও গলার গবলেট ও সিলিয়েটড কোষেও তাদের দেখা গেছে।

এই সার্স-কভ-২ ভাইরাসের কৌশল হল শ্বাসনালীর পথে চটজলদি শরীরে ঢুকে পড়া। নাক, মুখ বা গলা দিয়ে ঢুকে পড়তে পারলেই তারপর কোষের রক্ষীদের হাত করে গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়া সম্ভব হবে।

এখন কোষের রক্ষীদের তো হাত করল, ভেতরে ঢোকার কৌশলটা কী?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুরুতে জানা গিয়েছিল শুধুমাত্র কোষের সারফেসে থাকা ACE2 (অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম ২) প্রোটিনের সঙ্গে জোট বাঁধে ভাইরাসের স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন। এখন জানা যাচ্ছে শুধু এই প্রোটিন নয়, TMPRSS2 প্রোটিনকেও তারা কব্জায় আনতে পেরেছে। সার্স-কভ-২ ভাইরাসের কাঁটার মতো খোঁচা খোঁচা অংশগুলোই হচ্ছে স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন (S) । এই প্রোটিন হচ্ছে ভাইরাসের চাবি যার সাহায্যে কোষে ঢোকার প্রবেশপথটা খুঁজে বার করে তারা। এ

খন দেহকোষের সব প্রোটিন কিন্তু ভাইরাসকে কোষে ঢুকতে দেবে না। যেসব কোষে তার এই দুই বন্ধু প্রোটিন ACE2 ও TMPRSS2 থাকবে সেখানেই ঢুকতে পারবে ভাইরাস। দেহকোষের প্রোটিনের সঙ্গে জোট বেঁধে ঢুকে পড়বে কোষের ভেতরে।

নাক, গলা, ফুসফুস, হার্ট, কিডনি, লিভার, চোখ-সহ দেহের নানা অঙ্গের ২০ রকম কোষ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তৈরি হয়েছিল একটা ডেটাবেস। তাতে দেখা গিয়েছিল, দেহের এইসব অঙ্গেই ওই দুই প্রোটিন বহাল তবিয়তে আছে। তাই শুধু ফুসফুস নয়, হার্ট, কিডনি, লিভার এমনকি অন্ত্রেও সংক্রমণ ছড়াতে পারছে ভাইরাস।

এমনও দেখা গেছে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের কারণে খাদ্যনালীতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। কোভিড রোগীর দেহের নানা অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার প্রমাণও মিলেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই দুই প্রোটিনই দেহকোষে ঢোকার ও প্রতিলিপি তৈরি করে ছড়িয়ে পড়ার রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছে মারণ ভাইরাসকে।

ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউটের গবেষক ডক্টর ওয়ারাডন সাঙ্গনাক বলছেন, “নাক, গলা হল প্রাথমিক রাস্তা। সেখানকার কোষে ঢুকে বাকি কৌশল ঠিক করে নেয় এই ভাইরাস। শ্বাসপথে ফুসফুসে ঢুকেও তারা কোষের প্রোটিনের সঙ্গে জুটি বেঁধে গোটা শ্বাসযন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র শ্বাসকষ্টে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। এরপরে ধীরে ধীরে রক্তস্রোতের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিকে নিশানা বানাতে থাকে।”

গবেষক বলছেন, নাক, গলা ছাড়াও চোখের মাধ্যমেও ঢুকতে পারে ভাইরাস। সেখানেও রয়েছে গবলেট কোষ। চোখের জলের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়াবার রাস্তা খুঁজে নিয়েছে তারা।